হাওরাঞ্চলকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি
- আপলোড সময় : ৩০-০৭-২০২৫ ১২:০৭:৫৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩০-০৭-২০২৫ ১২:০৭:৫৮ পূর্বাহ্ন

হাওর মানেই বর্ষায় জলমগ্ন এক বিস্তীর্ণ ভূপ্রকৃতি, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের সহাবস্থানের এক চিরন্তন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বর্ষার মৌসুমেও সুনামগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পানির দেখা নেই। হাওরের বুক চিরে ফসল রক্ষা বাঁধ শুকনো মাটির মতো জেগে উঠেছে, জলজ প্রাণবৈচিত্র্য ও কৃষি উভয়ই বিপন্ন। হাওরে মাছ নেই, জীবন-জীবিকাহীন হয়ে পড়ছে হাওরপাড়ের মানুষ। এটি নিছক কোনো প্রাকৃতিক বিচ্যুতি নয়; বরং জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয়েরই নির্মম প্রতিফলন।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টে মানুষের ভূমিকাই আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যেমন বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রকট হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের ভেতরেও চলছে প্রকৃতির ওপর একধরনের আগ্রাসন - অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় ভরাট, বন উজাড়, নদী-খাল খননে অবহেলা, উজানের পানিপ্রবাহ রোধ ইত্যাদি। এর যোগফলই আজ হাওরের পানিশূন্যতা, কৃষি ও মৎস্য সংকট।
হাওর অঞ্চলের মানুষ শুধু প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল নন, তারা প্রকৃতিরই অংশ। কিন্তু যেভাবে হাওরাঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ বদলে যাচ্ছে, তাতে এই জনগোষ্ঠী আর প্রাকৃতিক নিয়মে জীবন চালিয়ে নিতে পারছেন না। গবেষণা বলছে, বনাঞ্চল ধ্বংস আর অনিয়ন্ত্রিত বাঁধ নির্মাণের কারণে বৃষ্টিপাতের নিয়মিত ধারা ভেঙে গেছে। মেঘালয়ের উজানে বৃষ্টি না হলে, ভাটিতে হাওরে পানি আসবে না - এটা পুরনো বৈজ্ঞানিক সত্য। কিন্তু তা বোঝার ও সেই অনুযায়ী নীতি প্রণয়নের সদিচ্ছার অভাব দীর্ঘদিনের।
কৃষি ও মৎস্যনির্ভর হাওরবাসী আজ চরম অনিশ্চয়তায়। এই সংকট শুধু তাদের ব্যক্তি সমস্যা নয়, এটি জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তার হুমকিস্বরূপ। কারণ হাওরের ধান ও মাছ দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই হাওরে পানি না থাকা মানে শুধু ধান-মাছের উৎপাদন কমে যাওয়া নয়, বরং এটি সামগ্রিকভাবে পরিবেশ, কৃষি, খাদ্যব্যবস্থা ও জীবন-জীবিকার ওপর এক ভয়াবহ ছায়া ফেলে দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে সরকার, নীতিনির্ধারক এবং সচেতন নাগরিক সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাওরাঞ্চলকে রক্ষা করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন জরুরি। বর্ষার পানি ধারণের ব্যবস্থা, জলাধার রক্ষা, বনভূমি পুনঃস্থাপন, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ বন্ধ, নদী-খাল খননের উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। এর পাশাপাশি হাওরবাসীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে।
সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে, পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করা। প্রকৃতিকে জয় করা নয়, বরং তার নিয়মকে বুঝে চলা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সচেতনতা এবং কার্যকর নীতিগত পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই হাওরের প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এই সংকট থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদের। হাওরের কান্না যেন অরণ্যের আর্তনাদে রূপ না নেয়। এখনই সময় প্রকৃতি ও পরিবেশের কাছে মাথা নত করে, তাকে রক্ষা করার শপথ নেবার। না হলে হাওর আর আমাদের বাঁচবে না, বাঁচবে না প্রকৃতি, মানুষ এবং ভবিষ্যতও।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ